প্রকাশিত:
৩ জুন ২০২৫, ১৫:১০
সম্প্রতি আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের (AGU) সম্মেলনে প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় ভূবিজ্ঞানীরা এক বিপর্যয়কর তথ্য সামনে এনেছেন—ভারতীয় উপমহাদেশের প্লেট ভেঙে যাচ্ছে! হিমালয়ের নিচে ভূত্বকের গভীরে চলছে এক মারাত্মক ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন "ডিলামিনেশন"। এর অর্থ হলো, ভারতীয় প্লেটের নিচের ঘন অংশটি উপরের স্তর থেকে আলাদা হয়ে ম্যান্টলে ডুবে যাচ্ছে। এর ফলে গোটা ভূগঠন কাঠামো বদলে যেতে পারে, বাড়তে পারে ভূমিকম্পের ঝুঁকি।
গত ৬০ মিলিয়ন বছর ধরে ভারতীয় প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের সাথে সংঘর্ষে হিমালয় পর্বতশ্রেণি গঠিত হয়েছে। এতদিন বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন ভারতীয় প্লেট অনুভূমিকভাবে তিব্বতের নিচে গিয়ে প্রবেশ করছে বা সাবডাক্ট হচ্ছে। কিন্তু নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে এক তৃতীয় সম্ভাবনা—ভারতীয় প্লেট নিজেই চিরে যাচ্ছে! গবেষকরা বলছেন, একাধিক গভীর ভূকম্পনের তরঙ্গ এবং দক্ষিণ তিব্বতের উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে সংগৃহীত হেলিয়াম-৩ আইসোটোপের ভিত্তিতে তারা বুঝতে পেরেছেন যে ভূত্বকের নিচে গরম ম্যাগমা উপরের দিকে উঠে আসছে—যা সম্ভব হতো না যদি প্লেটে চিড় না ধরতো।
গবেষকরা বলছেন, ভারতের প্লেটে যে ভাঙন ধরেছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন পাওয়া গেছে ভুটানের কাছাকাছি হিমালয়ের নিচের একটি এলাকায়। এই জায়গাটিকে বলা হয় সাবডাকশন জোন, যেখানে এক টেকটোনিক প্লেট আরেকটির নিচে ঢুকে যায়।
এই এলাকায় বিজ্ঞানীরা হেলিয়াম গ্যাস বিশ্লেষণ করেছেন, যা মাটির গভীর থেকে উঠে আসে। হেলিয়াম দুই রকমের হয়—একটি সাধারণ, যা মাটির অভ্যন্তর থেকে আসে, আরেকটি হেলিয়াম-৩ নামে পরিচিত, যা সাধারণত পৃথিবীর ম্যাণ্টল (ভূপৃষ্ঠের নিচের গরম স্তর) থেকে উঠে আসে।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটা রেখার দক্ষিণ দিকে হেলিয়াম সাধারণ ছিল—মানে, সেটা এসেছে পৃথিবীর বাইরের স্তর থেকে। আর রেখার উত্তরে যেসব উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে, সেখানে পাওয়া গেছে হেলিয়াম-৩, অর্থাৎ গভীর ম্যাণ্টল থেকে আসা গ্যাস।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই রেখার দক্ষিণ দিকেই তিনটি উষ্ণ প্রস্রবণে পাওয়া গেছে হেলিয়াম-৩। এর মানে হচ্ছে, কোথাও একটা বড় ফাটল হয়েছে, যার মাধ্যমে নিচের গরম ম্যাগমা এবং গ্যাস উপরের দিকে উঠে আসছে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে, ভারতীয় প্লেটের একটা অংশ নিচের দিক থেকে ভেঙে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, আর সেই ভাঙা জায়গা দিয়ে ম্যাণ্টলের গ্যাস ও গরম পদার্থ উপরের দিকে উঠে আসছে। এই ডিলামিনেশন কেবল ভূগঠনের দিক থেকে নয়, মানব জীবনের দিক থেকেও বড় হুমকি। কারণ এতে প্লেটের অভ্যন্তরে চাপের ধরণ বদলে যাচ্ছে। এর ফলে ভূকম্পনের ধরন, পরিমাণ এবং তীব্রতা আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই প্রক্রিয়া পুরো সাবডাকশন ফ্রন্ট জুড়ে ছড়িয়ে থাকতে পারে এবং এটাই হিমালয় অঞ্চলের জটিল ভূকম্পন কাঠামোর অন্যতম কারণ হতে পারে।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ভারতীয় প্লেটের অভ্যন্তরে যে ধরণের ভাঙন ধরা পড়েছে, তা ভূমিকম্প সংক্রান্ত পূর্বাভাস ও ঝুঁকির মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এখন পর্যন্ত ভূমিকম্প পূর্বাভাসের জন্য বিজ্ঞানীরা সাধারণত ধরে নেন যে, ভূমিকম্প মূলত টেকটোনিক প্লেটের প্রান্তে সংঘটিত হয়—যেখানে একটি প্লেট আরেকটির সাথে ধাক্কা খায় বা সরে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এইবার ভূমিকম্পের সূত্রপাত হচ্ছে প্লেটের মাঝখানেই, ভেতরে ভেতরে চিড় ধরে। এই চিড় বা ফাটল একদম নিচের স্তর থেকে শুরু হয়ে উপরের দিকে এগোচ্ছে, যা পূর্বের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
গবেষণায় পাওয়া এমন একটি ভাঙ্গন লাইনের অবস্থান তিব্বতের কনা-সাংরি রিফট (Cona-Sangri Rift) নামক এলাকায়, যা আগে থেকেই ভূ-পৃষ্ঠে দৃশ্যমান ছিল। এই রিফট আসলে একটি গিরিখাতের মতো ভূ-আকার, যা দুই দিক থেকে টান পড়ে তৈরি হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, এই রিফটের অবস্থান সেই গভীর ভাঙ্গনের ঠিক উপরে, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে হেলিয়াম গ্যাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
এতে স্পষ্ট হচ্ছে যে, পৃথিবীর অভ্যন্তরের গভীর ফাটল সরাসরি ভূ-পৃষ্ঠের গঠন ও পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই সংযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পরিবর্তনের প্রভাব ভূ-পৃষ্ঠে কীভাবে পড়ে, তা বোঝা যায়।
লিহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূকম্পবিদ অ্যান মেল্টজার বলেন, “এই ধরনের গভীর প্লেট চিড়ের সঠিক মানচিত্র তৈরি করতে পারলে, আগাম ভূমিকম্প পূর্বাভাস দেওয়া অনেক সহজ হবে।”
এই কারণেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্প পূর্বাভাসের প্রচলিত মডেলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে। শুধু প্লেটের সীমানা নয়, বরং প্লেটের অভ্যন্তরেও যে ধরণের চাপ ও চিড় সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলোকেও এখন থেকে হিসেবের মধ্যে আনতে হবে।
মন্তব্য করুন: