প্রকাশিত:
২৬ মে ২০২৫, ১৫:৩০
গা-জ্বালা অসহনীয় তাপদাহের পর কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে করতোয়া, ফুলজোড় ও হুরাসাগরসহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও বাড়তে শুরু করেছে। ফলে প্রতিদিনই ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। ভাঙন শুরু হওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে যমুনাপাড়ের মানুষগুলো।
এদিকে, দ্রুত পানি বৃদ্ধির কারণে ভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে শাহজাদপুরের তিন ইউনিয়নের ৯টি গ্রাম। হুমকির মুখে রয়েছে মাদ্রাসা, হাইস্কুল ও প্রাইমারি স্কুলসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো সময় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সোমবার (২৬ মে) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের ভাটপিয়ারী ও শাহজাদপুরের সোনাতনী ইউনিয়নের মাকড়া, ধীতপুর, কুড়সী, বারপাখিরা, বড় চামতারা, বানতিয়ার, গালা ইউনিয়নের বৃ-হাতকোড়া, মোহনপুর গ্রাম ও কৈজুড়ি ইউনিয়নের চর-ঠুটিয়া গ্রামে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই এসব গ্রামের অধিকাংশ ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি, মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সোনাতনী ইউনিয়নের ধীতপুর গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৬৫) জানান, তার জীবদ্দশায় ১৪ বার ভাঙনের শিকার হয়ে বর্তমানে নিঃস্ব। অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছি। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সেই ঘরের পাশে চলে এসেছে আগ্রাসী যমুনা নদী। এবার ভাঙলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। পরিবার নিয়ে কোথায় থাকবেন সেটা ভেবেই দিন-রাত পাড় করছে। মনোয়ারা বেগমের মতো ধীতপুর গ্রামের অসংখ্য মানুষ ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
একই গ্রামের গ্রামের কালু মোল্লা (৭৫) বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে সোনাতনী ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে ভাঙন শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ বার ভাঙ্গনের কবলে পরেছি। ভাঙনে বাড়ি-ঘর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। সব হারিয়ে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করছি। এ চরের জমিতে পটল, বেগুন, ধান, বাদাম, মাষকলাই, বাঙ্গি, সবজি, ধনিয়াসহ সব ধরনের ফসলের ভালো ফলন হয়। এসব ফসল ফলিয়ে ভালোই দিন কাটছিল আমাদের। কিন্তু এসব জমি আর বাড়ি-ঘর ভাঙনের মুখে পড়েছে। এ ভিটা ভেঙে গেলে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো, কী খাবো- তা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছি।
আক্ষেপ করে কৃষক ফজর আলী বলেন, নদী ভাঙতে ভাঙতে সবশেষ হয়ে গেলেও সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। আমরা যুবক থেকে বুড়ো হয়ে গেছি, ভাঙন রোধে শুধুই আশ্বাস পেয়েছি, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
কুড়সি গ্রামের মাওলানা নজরুল ইসলাম বলেন, সোনাতনী ইউনিয়নের মাটি সোনার মতোই উর্বর। এখানে যে ফসলই বোনা যায়, ব্যাপক ফলন হয়। যমুনা নদীর ভাঙনে গরুর হাট, মসজিদ, মাদ্রাসা, বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি সবই হারিয়ে যাচ্ছে। এতে চরের মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ছে। ভাঙন রোধে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ইউনিয়নটি মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন।
তারা বলেন, গত এক বছরে সোনাতনী ইউনিয়নের শ্রীপুর থেকে বারোপাখিয়া পর্যন্ত পাঁচ/ছয়টি গ্রামের প্রায় ৩ থেকে ৪ শতাধিক বাড়ি-ঘর যমুনা নদীতে চলে গেছে। ভাঙন রোধে এখানে দ্রুত বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কথা হয় সদর উপজেলার ভাটপিয়ারী গ্রামের আমজাদ আলী, আব্দুল হামিদ, হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন কৃষক বলেন, যমুনার ভাঙনে ভাটপিয়ারী গ্রামটি পুরোই নদীগর্ভে চলে গেছে। দফায় দফায় বাড়ি-ঘর ভেঙে এখানকার কৃষকেরা ওয়াপদা’র পাশে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভাঙনে কৃষকেরা আতঙ্কে রয়েছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনরোধ না হলে শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীনের আশঙ্কায় রয়েছে।
শাহজাদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জেরিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘ ৬ বছর ধরে ৩টি ইউনিয়নের গ্রামগুলিতে কমপক্ষে ২৮০ হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আবার এর বিপরীত পাশে ৯০ হেক্টর বেশি জমি জেগে উঠেছে। ফলে এ ইউনিয়নে জমির পরিমাণ কমেনি। তবে যে সব ফসলি জমি নতুন করে ভেঙ্গে যাচ্ছে , সে সব জমির মালিক তাৎক্ষণিক ভাবে কিছুটা হলেও ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজ্জামান বলেন, নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে সোনাতনী ইউনিয়নসহ চরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, সদর ও শাহজাদপুর উপজেলায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন এলাকা পরিদর্শনসহ সেখানে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।
তবে চরাঞ্চলের উন্নয়নে একটি প্রকল্প চালু হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি চালু হলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
মন্তব্য করুন: