প্রকাশিত:
১০ মার্চ ২০২৫, ১৪:০৫
ব্যবসায় প্রশাসনে (বিবিএ) পড়ার আগ্রহ দেশের বহু শিক্ষার্থীর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ব্লকচেইন, মেশিন লার্নিংয়ের যুগে বিবিএর চাহিদা কি কমছে? নাকি তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কাজের সুযোগ? এসব নিয়েই লিখেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডিন এ কে এম ওয়ারেসুল করিম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, রোবোটিকস কিংবা ব্লকচেইনের মতো উন্নত প্রযুক্তির যুগে এসেও বিবিএ বা ব্যবসাবিষয়ক পড়াশোনার চাহিদা কমেনি। বরং এ বিষয়ে পড়ালেখার নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে। তাতে চাকরির সুযোগ আরও বাড়ছে। ব্যবসা পরিচালনার জন্য মানুষ লাগবেই। এখানে পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর হওয়া দুষ্কর। তবে যাঁরা ব্যবসা পরিচালনা করবেন, তাঁদের প্রযুক্তির জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে ব্যবসা চলবে না; বা চলছিল না বলেই ১৯৩০-এর দশকে ব্যবসাবিষয়ক পড়াশোনার জন্ম হয়। এর লক্ষ্য ছিল, একধরনের পেশাদার মানুষ তৈরি করা। যাদের ব্যবসা করার মানসিকতা থাকলেও টাকা নেই। কিন্তু এ বিষয়ে ভালো জানাশোনা আছে। তারা অন্যের ব্যবসা দেখভাল করবে। বিনিময়ে মাস শেষে বেতন নেবে। সেই থেকে ব্যবসাবিষয়ক পড়াশোনার শুরু।
এরপর অনেক সময় বয়ে গেছে। এখন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে কম খরচে ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা যায়, সেই চেষ্টা চলছে। কিন্তু মানুষের বিকল্প কিছু পুরোপুরি ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব নেবে, এমন চিন্তা কোনোভাবে করা যায় না। এটা সম্ভবও নয়। সুতরাং সবকিছু প্রযুক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে মানুষের হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে কীভাবে প্রযুক্তি আরও সফলভাবে ব্যবহার করা যায়, পড়াশোনার বিষয়বস্তুতে তা অগ্রাধিকার দিতে হবে। সময়োপযোগী করে পাঠ্যক্রম সাজিয়ে নিতে হবে। তাহলে ব্যবসাবিষয়ক পড়াশোনা শেষে চাকরির বাজারে এ–সংক্রান্ত গ্র্যাজুয়েটদের সুযোগের অভাব হবে না। মনে রাখতে হবে, দিন শেষে তারাই টিকে থাকবে, যারা দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
আমাদের সময় থেকে এখনকার সময়ে পড়াশোনার অনেক কিছু বদলে গেছে। ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আমরা যখন ব্যবসাবিষয়ক পড়াশোনা করি, তখন শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ঘুরে, বই ঘেঁটে, নতুন নতুন বিষয় শিখতে হতো। যেমন আমরা ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী; বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ছাড়াও বইয়ের খোঁজে জগন্নাথ কলেজের (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) গ্রন্থাগারে ছুটে গিয়েছি। নতুন বিষয় শিখতে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শুরু করে ঢাকার বড় বড় গ্রন্থাগারে যেতে হয়েছে। এ–সংক্রান্ত ভালো বই পাওয়া কঠিন ছিল। এখনকার শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। ইন্টারনেটের কল্যাণে সবকিছুই এখন হাতের কাছে।
পাঠ্যক্রমেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। যেমন আমরা ডিজিটাল ইকোনমি বা মার্কেটিং নিয়ে কিছু পড়িনি। যেটা এখন বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। আমরা পড়েছি অন্ট্রাপ্রেনারশিপ বা উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়। কিন্তু এখন স্টার্টআপ নিয়ে পড়তে হচ্ছে। স্টার্টআপ বা ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মতো শব্দের প্রচলন তখন ছিল না। ব্যবসার রিস্ক বা ঝুঁকিসংক্রান্ত বিষয় এখন যতটা জোর দিয়ে পড়ানো হয়, তখন এতটা হতো না। আবার দেখুন, বিভিন্ন আইন বা নীতি সময়ের সঙ্গে বদলেছে। তবে অ্যাকাউন্টিং বা ফাইন্যান্সের মৌলিক বিষয়গুলো আগের মতোই আছে। এখন ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে প্রতিনিয়ত শুধু হালনাগাদ হচ্ছে। জানার সুযোগ বেড়েছে। প্রয়োগও বেড়েছে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মতো বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে চাকরির বাজার উপযোগী দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির জন্য। এ ক্ষেত্রে শিল্প খাতের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আর এটা হতে হবে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই চেষ্টা আমাদের দিক থেকে আছে। শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ উদ্যোগে যেটা করা একটু কষ্টসাধ্য। তবে আমাদের শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই। তারা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। নানা ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এতে করে শিল্প খাতের লোকজনের সঙ্গে তাদের একধরনের যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে। যেটা পরে নানাভাবে কাজে আসছে।
বিবিএ বা ব্যবসাবিষয়ক পড়াশোনা খুবই প্রায়োগিক এবং কৌতূহলোদ্দীপক। এটা সাহিত্যের মতো কল্পনার জগৎ নয়, আবার বিজ্ঞানের মতো কাঠখোট্টা বিষয়ও নয়। আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেই বড় হই। প্রতিদিন ব্যবসায়িক কোনো না কোনো কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে হয়। সুতরাং এই শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের সঙ্গে আমরা নানাভাবে পরিচিত। তবে এটা সত্য, ডেপ্রিসিয়েশন, জার্নাল কিংবা লেজার—শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা খুব বেশি পরিচিত নই। যেগুলো হয়তো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিখতে হয়।
তবে ব্যবসাবিষয়ক পড়াশোনার শুরুতে একজন শিক্ষকের উচিত তাঁর শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া—ভবিষ্যতে তাকে বড় একটি ব্যাংক কিংবা করপোরেশন পরিচালনা করতে হতে পারে। তাহলে পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা নিজেদের কোথায় নিয়ে যেতে পারবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা পাবে। বিবিএ পড়ার আগ্রহ আরও বাড়বে। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে এ–সংক্রান্ত পড়াশোনার ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে আমি মনে করি, শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ আরও বাড়াতে হবে। অন্তত তিন বছর পরপর সিলেবাস পর্যালোচনা করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক সুবিধা নিশ্চিতে জোর দেওয়া দরকার। শিক্ষায় বড় সংস্কার প্রয়োজন। সামগ্রিক সংস্কারের পরিবেশে যা ত্বরান্বিত হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।
মন্তব্য করুন: