প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:৪৪
সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া এক অভিভাষণে এমন মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
অনুষ্ঠানে অতিথির হিসেবে বক্তব্য রাখেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.আসিফ নজরুল ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো.আসাদুজ্জামান।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা।
বিচারকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন ও নওগাঁর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ মন্ডল।
উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, চার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও অধস্তন আদালতের বিচারকেরা ।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ন্যায় বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। তাই নতুন এ বাংলাদেশে আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ গড়তে চাই যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধ এর নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দূর্গে পরিণত হবে।
বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকররূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে। এছাড়াও আছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ, স্থায়ীকরণ ও উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে কোনো আইন না থাকা ও প্রথাগত জ্যেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো; যা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে।
একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। এ জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি।
বিচার বিভাগের সংস্কারের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য আমি জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগে কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। এ সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।
সরকারের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ন্যায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুতক্রমে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবো। ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং মঞ্চে উপবিষ্ট আইন উপদেষ্টার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, শুধু বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে কেবল সেটুকু নিশ্চিত করে বিচারক নিয়োগের ফলে সুপ্রিম কোর্টে এক অভূতপূর্ব অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায় বিচারের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
মামলাজট বিচার বিভাগের একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৪২ লাখ মামলা বিচার নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ আছে। মামলাজট নিয়ে সুধীমহলে অনেক ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু এটি মুদ্রার একটি পিঠ। মুদ্রার অন্য পিঠটা কখনো খুব বেশি আলোচনায় আসে না। মুদ্রার অন্য পিঠে আছে স্বল্প সংখ্যক লোকবল, এজলাস সংকট তথা অবকাঠামোগত অসুবিধাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা। কিন্তু এর মধ্যেও মাত্র ২০০০ বিচারক কর্তৃক এক বছরে গড়ে ১০ (দশ) লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। এ সংখ্যা প্রমাণ করে মামলাজটের কারণ বিচার বিভাগ বা বিচারকরা নন। বরং মামলা জটের অন্যতম কারণ হচ্ছে মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতা।
মন্তব্য করুন: