প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২৪, ১১:২৬
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্তির কথা বলে ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবকে সাউথ এশিয়া ইনস্যুরেন্স কম্পানির পরিচালক পদে বসিয়েছেন রাজস্ব কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান। কোনো ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ না করেই নিয়েছেন কম্পানির ১০টি শেয়ারের একটি।
এ ছাড়া এ পর্যন্ত আলোচিত এই কর্মকর্তা ও তাঁর স্বজনদের নামে থাকা ৬৫ বিঘা (দুই হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, আটটি ফ্ল্যাট, দুটি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদ প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে।
তাঁর নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও পাঁচটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। কলেজ শিক্ষক লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক।
তবে তাঁর প্রকৃত সম্পদের সঙ্গে হলফনামায় দেওয়া সম্পদের হিসাবে রয়েছে অনেক গরমিল।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাউথ এশিয়া ইনস্যুরেন্স কম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালে যখন সাউথ এশিয়া ইনস্যুরেন্স কম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হয়, তখন এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান খোঁজ পেয়ে কম্পানির শেয়ার গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মতিউরের মালিকানাধীন শাহজালাল সিকিউরিটিজের মাধ্যমে ইনস্যুরেন্স কম্পানিটি আইপিওতে অন্তর্ভুক্তি এবং পরবর্তী সময়ে শেয়ারের সমপরিমাণ অর্থ সমন্বয় করার শর্তে ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের মালিকানাধীন অর্ণব ট্রেডিং লিমিটেডের নামে একটি শেয়ার বাগিয়ে নেন। আর ছেলে অর্ণবকে বসিয়ে দেন কম্পানির পরিচালক পদে।
বর্তমানে ছেলে অর্ণব পরিচালক পদে থেকে কম্পানির সব সুবিধা গ্রহণ করছেন। কিন্তু শর্ত মোতাবেক আইপিওর কাজ ও শেয়ারের সমপরিমাণ অর্থ ফেরত দেননি বলে জানান কম্পানির একাধিক কর্মকর্তা।
লাকির হলফনামার সঙ্গে প্রকৃত সম্পদের গরমিল
মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। কয়েক দিন আগে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তাঁর হলফনামায় দেখা গেছে, লায়লা কানিজের সম্পদের মধ্যে ১৫৪ শতাংশ কৃষিজমি ছাড়াও রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে আট কাঠা, গাজীপুরে পাঁচ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬.৬০ শতাংশ ও ২.৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪.৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬.৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮.৭৫ শতাংশ, ২৬.২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬.১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ জমি।
নির্বাচনী হলফনামা বলছে, লায়লা কানিজের বার্ষিক আয় কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে তিন লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে এক লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা।
লায়লা কানিজ নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় নিজের নামে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, যশোর ও নাটোরে মোট ৮৪৮.৩৩ শতাংশ (২৫.৭০ বিঘা) জমি থাকার কথা বলেছেন। ফ্ল্যাটের হিসাব দিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের এক ভবনেই চারটি ফ্ল্যাটের নম্বর উল্লেখ করেছেন, যার মূল্য দেখিয়েছেন এক কোটি ৬১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
তবে ওই ভবনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানা গেছে, ভবনটির একেকটি তলায় চারটি করে অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। একেকটির আয়তন এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ বর্গফুট। নির্মাণের শুরু থেকে হস্তান্তর পর্যন্ত প্রতি বর্গফুট সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে। সর্বনিম্ন ধরলেও এই চারটি ফ্ল্যাটের দাম অন্তত তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর বাইরে আরো একটি ফ্ল্যাট থাকার কথা হলফনামায় উল্লেখ থাকলেও ঠিকানা দেওয়া হয়নি। তবে সেটির মূল্য দেখানো হয়েছে সাড়ে ৫৫ লাখ টাকা।
তিনি একটি মৎস্য খামারের মালিক বলেও হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। লায়লা কানিজ লাকি মোট যে জমির হিসাব দিয়েছেন, তার মধ্যে পাঁচ জেলার ১৩টি অকৃষি জমির অর্জনকালীন দাম দেখিয়েছেন চার কোটি ২৪ লাখ টাকা। বাকি ৯টি অকৃষি ও কৃষি জমির দাম উল্লেখ করেননি।
হলফনামার বাইরে ভূমি অফিসের নথি থেকে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মরজাল মৌজার চারটি দাগে লায়লা কানিজের নামে আরো দুই বিঘা (৬৬.৭৫ শতাংশ) জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর বিবরণীতে মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজ তাঁর মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা। তাঁর হাতে এবং ব্যাংকে নগদ তিন কোটি ৫৬ লাখ টাকা আছে বলে উল্লেখ করেছেন। পুঁজিবাজারের শেয়ার বিক্রি থেকে এক কোটি ৬৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা মুনাফার কথাও উল্লেখ করেছেন।
নির্বাচনের হলফনামায় লায়লা কানিজ লাকি তাঁর পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যবসা। নিয়মানুযায়ী, হলফনামায় প্রার্থীর স্বামী বা স্ত্রীর সম্পদের বিবরণও দিতে হয়। কিন্তু লায়লা কানিজ স্বামীর নাম উল্লেখ না করে বাবার নাম উল্লেখ করেছেন।
নরসিংদীর রায়পুরায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বাবা কফিল উদ্দিন আহাম্মদ ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির খাদ্য কর্মকর্তা। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে লায়লা কানিজ সবার বড়। তিনি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’ নামে একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক কিভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন, এ প্রশ্নও এখন সামনে এসেছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে লায়লা কানিজের তিনটি ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে দুটি নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। আরেকটি নম্বরে কল গেলেও তিনি রিসিভ করেননি।
মন্তব্য করুন: