প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২৪, ১৭:৫০
ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাংবিধানিক রীতিনীতি ও পরম্পরা রক্ষার মাধ্যমে সরকার চালানোর অঙ্গীকার করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি সংসদ ভবন চত্বরে জমায়েত করে উজ্জীবিত ও জোটবদ্ধ বিরোধীরাও বুঝিয়ে দিলেন, দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আজ সোমবার (২৪ জুন) ভারতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশন শুরু হয় নতুন সংসদ ভবনে। নবনির্মিত এই সংসদ ভবনে এবারই প্রথম অনুষ্ঠিত হলো সদস্যদের শপথ গ্রহণ পর্ব। অস্থায়ী বা প্রোটেম স্পিকার হিসেবে সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান ওডিশা থেকে নির্বাচিত বিজেপি সদস্য ভর্তৃহরি মহতাব। তাঁকে মনোনীত করার মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছে, সংসদীয় প্রথা ও রীতি রক্ষার ক্ষেত্রেও সরকারি ইচ্ছা ও ব্যাখ্যাই প্রাধান্য পাবে। এযাবৎ প্রোটেম স্পিকার মনোনীত হতেন তিনি, যিনি সব থেকে বেশিবার নির্বাচিত হয়েছেন। সেই অর্থে কংগ্রেসের কে সুরেশই ছিলেন যোগ্য। অথচ আটবারের এই নির্বাচিত সদস্যের বদলে সেই দায়িত্ব দেওয়া হলো সাতবারের জয়ী ভর্তৃহরি মহতাবকে, যিনি ভোটের ঠিক আগে বিজু জনতা দল (বিজেডি) ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারি যুক্তি, মহতাব পরপর সাতবার জিতেছেন। সুরেশ আটবার জিতলেও মধ্যে দুবার হেরেছেন।
সংসদ অধিবেশনের শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এবার সরকারকে প্রতিনিয়ত বিরোধী সংঘাতের মোকাবিলা করে যেতে হবে। আগামী বুধবার স্পিকার নির্বাচন দিয়ে তা শুরু হওয়ার কথা। অতীতে বারবার স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন সর্বসম্মতভাবে। ডেপুটি স্পিকারের পদটা দেওয়া হতো বিরোধীদের। এবার সেই পরম্পরা রক্ষিত হবে কি না, বড় প্রশ্ন। গত পাঁচ বছর লোকসভা চালানো হয়েছে ডেপুটি স্পিকার ছাড়াই।
বিরোধীদের দিতে হবে বলে মোদি সরকার ওই পদে নির্বাচনই করায়নি। এবার সেই আশ্বাস পেলে স্পিকার পদে নির্বাচন এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু না হলে পরাজয় হবে জেনেও বিরোধীরা ভোটাভুটিতে যেতে পারেন। কারণ, তাতে বোঝানো যাবে, মুখে সহমতের কথা বললেও মোদির সরকার বিরোধীদের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত নয়।
মোদি অবশ্য অধিবেশনের শুরুতে সহমতের কথা শুনিয়েছেন। সংসদ ভবনের বাইরে টানা ১৪ মিনিটের ভাষণে তিনি বলেন, সরকার চালাতে বহুমত (সংখ্যাগরিষ্ঠতা) প্রয়োজন। কিন্তু দেশ চালাতে গেলে দরকার সহমত। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাইকে নিয়ে চলতে চাই। সাংবিধানিক নিয়ম মেনে চলতে চাই। দেশের মানুষ আমাদের গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর দ্বিতীয়বার কোনো সরকার পরপর তিনবার জনাদেশ পেল। এই তৃতীয় মেয়াদে আমরা তিন গুণ পরিশ্রম করব। তিন গুণ বেশি ফল দেব।’
তবে বিরোধীদের, বিশেষ করে কংগ্রেসকে কটাক্ষ করতেও তিনি ছাড়েননি। বিরোধীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মানুষ দায়িত্বশীল বিরোধী পক্ষ চায়। দেশবাসী সংসদে ঝগড়া দেখতে চায় না। নাটকবাজি দেখতে চায় না। স্লোগান শুনতে চায় না। আশা করি, বিরোধীদের নিয়ে যে নিরাশা সৃষ্টি হয়েছিল, এবার তা থাকবে না।’
কংগ্রেসের নাম না করে তাদের তিনি বিদ্ধ করেন জরুরি অবস্থা নিয়ে। আগামীকাল জরুরি অবস্থা জারির ৫০ বছর। সে কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ওপর যাঁরা আস্থা রাখেন, গণতান্ত্রিক পরম্পরার প্রতি যাঁরা শ্রদ্ধাশীল, দিনটি তাঁরা কখনো ভুলতে পারেন না। জরুরি অবস্থা ছিল গণতন্ত্রের কালো দিন। ওই দিন সংবিধান অমান্য করে গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ হয়েছিল। গোটা দেশকে বানানো হয়েছিল জেলখানা। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনে ভারত আর কোনো দিন ফিরবে না।’
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে প্রধানমন্ত্রীর জবাব দিতে দেরি করেননি। মোদির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি ৫০ বছর আগের ঘটনা টেনে আনছেন। অথচ দশ বছর ধরে আপনি দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছেন। দেশবাসী টাটকা ঘটনা নিয়ে আপনার অভিমত শুনতে চায়। ৫০ বছর আগের কাসুন্দি না ঘেঁটে বরং পরীক্ষা কেলেংকারি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ট্রেন দুর্ঘটনা, মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলুন।’
ভোটের প্রচারে বিরোধীরা বিজেপিকে আক্রমণ করেছিল সংবিধান অবজ্ঞা করার জন্য। বলেছিল, বিজেপি ৪০০ আসন জিততে চাইছে, যাতে সংবিধান বদলে দেওয়া যায়। সংসদের অধিবেশনের প্রথম দিন সেই সংবিধান রক্ষারই শপথ নিলেন বিরোধীরা। পুরোনো সংসদ ভবনের প্রধান প্রবেশপথের সামনে, যেখানে গান্ধীজির মূর্তি ছিল, যা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই ফাঁকা জায়গায় ‘ইন্ডিয়া’জোটের সব শরিক জোটবদ্ধ হয়ে সংবিধান হাতে জড় হয়। কংগ্রেসের সোনিয়া গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, তৃণমূল কংগ্রেসের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া মৈত্র, ডিএমকের টি আর বালু, কানিমোঝিসহ সব বিরোধী সংসদ সদস্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখান। তাঁদের হাতে ছিল ভারতের সংবিধান।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা দিনের পর দিন সংবিধানের অসম্মান করে চলেছেন। এই আক্রমণ আমরা আর হতে দেব না। সংবিধান হাতে তাই আমরা শপথ নিতে এসেছি।’
আজ সোমবার (২৪ জুন) ও আগামীকাল মঙ্গলবার (২৫ জুন) শপথ গ্রহণ পর্বের পর আগামী বুধবার (২৬ জুন) হবে স্পিকার নির্বাচন। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। তারপরই বোঝা যাবে ১০ বছর বিজেপি যেভাবে সংসদ চালিয়েছে, তার কোনো বদল ঘটছে কি না। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সর্বভারতীয় পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, ট্রেন দুর্ঘটনা, মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে সরকার বিব্রত। সেই বিব্রতবোধ বাড়িয়ে দেবে বিরোধীরা।
দণ্ড সংহিতা আইন কার্যকর হওয়ার কথা আগামী ১ জুলাই থেকে। তা স্থগিত রেখে ওই আইন নতুনভাবে বিবেচনার দাবি উঠেছে। ১৪৬ জন সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করে ওই তিন আইন সংসদে পাস করানো হয়েছিল। এবার বিরোধী শক্তি ২৩৬। বিজেপিও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ। শরিকনির্ভর বিজেপির পক্ষে এবার একতরফা সংসদ চালানো কঠিন।
সংসদীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন কিরেন রিজিজু। আজ ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে সব সদস্যকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, সহযোগিতার জন্য সদা প্রস্তুত। সুষ্ঠুভাবে সংসদ চালাতে সদর্থক মনোভাব নিয়ে চলবেন। কংগ্রেস মুখপাত্র ও রাজ্যসভার সদস্য জয়রাম রমেশ তাঁকে পাল্টা মনে করিয়ে দেন, ‘কাজই বুঝিয়ে দেবে কথার মূল্য। প্রতিশ্রুতি রাখুন। কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করুন।’ বোঝাই যাচ্ছে, শুরু থেকেই সংসদ গমগম করবে।
মন্তব্য করুন: